অনুগল্প এক: সন্ধ্যার আলো তখন ম্লান। গ্রামের এক কোণে খড়ের ঘরে বসে আছেন আশি পেরোনো রহিম উদ্দিন। চোখে ঝাপসা দেখেন, কানে কম শোনেন, হাঁটতেও কষ্ট হয়। যৌবনে মাঠের পর মাঠ চাষ করেছেন, সন্তানদের মানুষ করেছেন, কিন্তু এখন একাকিত্বই তার প্রধান সঙ্গী। ছেলেমেয়েরা শহরে থাকে, মাঝে মাঝে খবর নেয় বটে, কিন্তু নিয়মিত যত্ন নেওয়ার সুযোগ কারও নেই। রহিম উদ্দিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবেন- “জীবনভর কাজ করলাম, বার্ধক্যে শান্তিটুকু কোথায়?”
অনুগল্প দুই: শহুরে প্রবীণ
ঢাকার এক ব্যস্ত আবাসিক এলাকায় বহুতল ভবনের ছোট্ট একটি ফ্ল্যাটে একা থাকেন সত্তরোর্ধ্ব রাশেদা খাতুন। স্বামী মারা গেছেন বহু বছর আগে, ছেলে-মেয়েরা সবাই বিদেশে বা অন্য শহরে কর্মরত। প্রতিদিন সকাল-বিকেল জানালা খুলে নিচের রাস্তায় ভিড়ভাট্টা দেখেন। অসুস্থ হলে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া দুঃসাধ্য, বাজারে যেতে হয় পাশের ফ্ল্যাটের কারও সাহায্যে। সারাদিন টেলিভিশনই তার সঙ্গী। একদিন আক্ষেপ করে বললেন- “ঢাকা শহরে এত মানুষ, অথচ মনে হয় আমি একেবারেই একা।”
বাংলাদেশের শহরে-গ্রামে লক্ষ লক্ষ প্রবীণ মোটামুটি একই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হচ্ছেন। বর্তমানে দেশে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় এক কোটি পঞ্চাশ লক্ষ। জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী কয়েক দশকে এ সংখ্যা দ্বিগুণ হবে। অর্থাৎ বাংলাদেশের বড় অংশ প্রবীণ জনগোষ্ঠীতে পরিণত হবে, যা রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
আসছে ১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। ১৯৯০ সালের ১৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ১ অক্টোবরকে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস ঘোষণা করা হয়। এরপর ১৯৯১ সাল থেকেই সারাবিশ্বে প্রবীণ দিবস পালিত হয়ে আসছে। শিশু আর বার্ধক্য এ দুই পর্যায়েই মানুষের অতিরিক্ত যত্নের প্রয়োজন হয়। প্রায় প্রতিটি শিশুই পরম মাতৃস্নেহে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পেলেও বৃদ্ধ বয়সে অনেকেই তাঁদের প্রয়োজনীয় সেবাযত্ন থেকে বঞ্চিত হন। অথচ সমাজের সবচাইতে অভিজ্ঞ এবং প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিবর্গ এ প্রবীণ জনগোষ্ঠীরই অংশ। আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮ শতাংশ প্রবীণ। দেশের আর্থ সামাজিক এবং রাজনৈতিক উভয় পরিমণ্ডলেই প্রবীণ
জনগোষ্ঠী খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শৈশবে জীবন শুরু আর বার্ধক্যে শেষ। আমাদের দেশে সাধারণত ষাটোর্ধ্ব বয়সীদের বৃদ্ধ বা প্রবীণ বলে অভিহিত করা হয়। প্রবীণদের বিভিন্ন সরকারি ও সামাজিক সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে এ বয়সসীমা বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রবীণ মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জনশুমারি ও গৃহগণনার প্রাথমিক প্রতিবেদনে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের
জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬। ২০১১ সালের আদমশুমারির হিসাবে, দেশের জনসংখ্যা ছিল ১৪ কোটি ৪০ লাখ ৪৩ হাজার ৬৯৭। জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ৫৩ লাখ ২৬ হাজার। তাঁরা মোট জনসংখ্যার ৯ দশমিক ২৮ শতাংশ। ২০১১ সালের জনশুমারিতে এ হার ছিল ৭.৪৭। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় এক কোটি ৫০ লাখ প্রবীণ রয়েছে। আগামী ২০৩০ সালে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দুইকোটি ছাড়িয়ে যাবে। ২০৫০ সালে এই সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার কোটি এবং ২০৬১ সালে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি হবে।
প্রবীণ জনগোষ্ঠীর বার্ধক্যকালীন জীবন নানা সমস্যায় জর্জরিত। কর্মক্ষমতা হারিয়ে অধিকাংশ প্রবীণ আয়বিহীন হয়ে পড়েন। সরকারি চাকরিজীবীদের একটি অংশ পেনশন পেলেও বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য নির্দিষ্ট আর্থিক নিরাপত্তা কাঠামো নেই। অন্যদিকে বার্ধক্যজনিত নানা রোগ- ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, বাত, হৃদরোগ কিংবা চোখের সমস্যা- তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়ায়। অথচ প্রবীণদের জন্য নির্দিষ্ট জেরিয়াট্রিক কেয়ার বা বার্ধক্যবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় এখনও যথেষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
সামাজিক ও পারিবারিক অবহেলাও প্রবীণ জীবনের বড় বাস্তবতা। সন্তানদের ব্যস্ততা, বিদেশে যাওয়া কিংবা শহুরে জীবনযাত্রার চাপের কারণে অনেক প্রবীণ একাকিত্বে দিন কাটান। পরিবারে থাকলেও তারা হয়ে পড়েন অবহেলিত। এর সঙ্গে যুক্ত হয় সম্পত্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব, মানসিক নির্যাতন কিংবা নিরাপত্তাহীনতা।
তবে আশার কথা, সরকার প্রবীণদের জন্য কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। বয়সভিত্তিক ভাতা কর্মসূচির আওতায় প্রায় পঞ্চাশ লাখ মানুষ মাসিক ভাতা পাচ্ছেন। ২০১৩ সালে প্রণীত প্রবীণ নীতিতেও স্বাস্থ্যসেবা, বাসস্থান ও সামাজিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তার কথা বলা আছে। কয়েকটি হাসপাতালে প্রবীণ-বান্ধব কাউন্টার চালু হয়েছে। তবে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর বিশাল চাহিদার তুলনায় এ উদ্যোগগুলো এখনও অপ্রতুল।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রবীণদের মর্যাদাপূর্ণ জীবন নিশ্চিত করতে হলে আরও অনেক কিছু করা প্রয়োজন। সামাজিক ভাতা বাড়ানো এবং সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা, প্রতিটি জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে জেরিয়াট্রিক ইউনিট চালু করা, পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ে এবং শ্রেণিকক্ষে প্রবীণদের যত্ন ও শ্রদ্ধার সংস্কৃতি তৈরি করা এবং প্রবীণ নির্যাতন রোধে আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা জরুরি। একই সঙ্গে স্থানীয় পর্যায়ে প্রবীণ ক্লাব বা কমিউনিটি সাপোর্ট সেন্টার গড়ে তোলার মাধ্যমে তাদের সামাজিক মেলামেশা ও মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা যেতে পারে।
বাংলাদেশের উন্নয়নযাত্রায় প্রবীণ জনগোষ্ঠীর অবদান অপরিসীম। প্রবীণদের জীবনকাল বিসর্জনের মাধ্যমেই গড়ে উঠেছে আমাদের এই আধুনিক উন্নতমানের সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা। আধুনিক ও নবীন সমাজ সকলে দায়বদ্ধ প্রবীণ সমাজের নিকট। প্রবীণরাই আমাদের শিশুকাল, শৈশবকাল ও কৈশোরকালের লালন-পালনকারী। প্রবীণদের প্রতি কোন বৈষম্য নয়, কোন করুণা নয় কোন অবহেলা নয় বরং প্রদর্শন করতে হবে নৈতিক ও আদর্শিক প্রতিদান। তারাই আমাদের জীবনের শত প্রেরণার নিরন্তর উৎস। শুধু বয়সের কারণে প্রবীণরা গুরুত্বহীন অবস্থায় অবমূল্যায়নের জীবন ধারণ করবেন, তা সচেতন ও সভ্যসমাজে হতে পারে না। প্রবীণেরা পরিবার ও সমাজে অবহেলিত। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা নানাভাবে অবহেলার শিকার হন। মা-বাবা শত প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও তাঁর সন্তানকে কখনো ভাগ করেন না। তেমনি বৃদ্ধ বয়সে মা-বাবাকে ভাগ করা যাবে না। একজন সক্ষম মানুষ তার জীবনের পুরোটা সময় শেষ করে দেয় যে পরিবারের জন্য, জীবনের শেষ সময়ে সেই পরিবারে থাকাটা তার নৈতিক অধিকার। প্রবীণদের অভিজ্ঞতা ও পরামর্শ কাজে লাগিয়ে নবীনদের এগিয়ে যেতে হবে। সুস্থ সবল প্রবীণের মেধা ও অভিজ্ঞতাকে রাষ্ট্র এবং সমাজের বিভিন্ন উন্নয়ন ও সেবামূলক কাজে লাগানো যেতে পারে। তারুণ্যের উচ্ছ্বাস ও কর্মক্ষমতার সঙ্গে প্রবীণদের মেধা-মনন-অভিজ্ঞতা সংযোগ করা যায়, তাতে দেশের উন্নয়নের গতি আরও বাড়বে। তাই প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে পরিবার ও সমাজে যথাযথ মর্যাদা দিতে হবে। পিআইডি ফিচার। লেখক- প্রশাসনিক কর্মকর্তা, আঞ্চলিক তথ্য অফিস, সিলেট।