
সুনির্মল সেন |১৯৭১ সালের ১৬ নভেম্বরের ঘটনা। তখন ১০থেকে ১২জন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা সঙ্গে নিয়ে জগৎজ্যোতি তাড়া করেন কিছু নৌকার যাত্রীদের অত্যাচার করা রাজাকারদের।
জগৎজ্যোতির কাছে ওইসময় ছিলো সামান্য গোলাবারুদ। তার অদূরেই ছিলো ২০০ জনের হানাদারদের ক্যাম্প। সে সময় কৌশলে তাদের সেখানে নিয়ে যায় স্থানীয় রাজাকাররা। দাস পার্টি আটকা পড়ে।
ওখানে আটকা পড়ে জগৎজ্যোতি নিমিষেই বুঝে ফেলেন, তাঁদের ফাঁদে ফেলা হয়েছে। কভার ফায়ার দিয়ে বাকিদের যাওয়ার জায়গা করে দেন তিনি ও ইলিয়াস।
যুদ্ধে আহত ইলিয়াসের গু//লিবিদ্ধ ক্ষততে এক টুকরা কাপড় বেঁধে আবার শত্রুদের গতি দমাতে থাকেন, ঠিক যেভাবে নান্নু মিঞাকে কাঁধে নিয়ে শত্রুদের গতি রোধ করেছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ।
এদিকে ম্যাগাজিন লোড করে শত্রুর অবস্থান দেখতে মাথা উঁচু করতেই নিমিষে শত্রুপক্ষের ১টি গু লি জগৎজ্যোতি’র চোখে বিদ্ধ হয়। মেশিনগান হাতে উপুড় হয়ে পাশের বিলের পানিতে ঢলে পড়েন জ্যোতি।
যে দেশ স্বাধীন করার জন্য জগৎজ্যোতি হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রাম করেছিলেন। একসময় হানাদারদের গুলির আঘাতে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। স্বাধীন দেশ তিনি দেখে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জ্যোতির ভাগ্যে সে স্বাধীন দেশ দেখে যাওয়া সম্ভব হয় নি।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বৃহত্তর সিলেটের হাওর অঞ্চল দাপিয়ে বেড়ানো অসীম সাহসী এই দলটি ছিল ‘দাস পার্টি’। এর কমান্ডার ছিলেন জগৎজ্যোতি দাস।
মাত্র ৩৬-৪২ জন যোদ্ধার এই গেরিলা দল পাকিস্তানি বাহিনী ও তার দোসরদের বুকে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল ভাটি অঞ্চলে। এতোটাই সাহসী ছিলো তারা যে পাকিস্তান সরকার জগৎজ্যোতি দাসের উপর একটা বাউন্টি রাখে।
১৯৭১ সালের ১৬ নভেম্বর, ২৭ রমজানে যখন পুরো বিশ্ব ঈদের প্রস্তুন্তি নিচ্ছিলো। সেদিনই পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা জগৎজ্যোতি দাসকে মে/রে বৃহত্তর সিলেটের তৎকালীন সুনামগঞ্জ মহকুমার আজমিরীগঞ্জ বাজারে নিয়ে আসে।
মুক্তিকামী মানুষের বুকে ভয় ধরাতে জনসন্মুখে জ্যোতির মরদেহের ওপর চলে পৈশাচিক বর্বরতা। মুক্তিযোদ্ধাদের করুণ পরিণতি এলাকার মানুষকে দেখাতে ঈদের আগে আগে তাঁর মৃতদেহ বেঁধে রাখে বাজারের বৈদ্যুতিক খুঁটির সাথে ।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য সেক্টরের মতো দাস পার্টির সমর সমীকরণ সহজ ছিলো না। ভাটি অঞ্চলে যুদ্ধক্ষেত্র; দুর্গম, প্রতিকূল ও বিপদসংকুল অঞ্চল। কিন্তু বুকভরা সাহস, বুদ্ধিমত্তা আর দেশপ্রেম পুঁজি করে জগৎজ্যোতি ও তার ‘দাস পার্টি’ প্রত্যন্ত এলাকাকে করে তুলেছিলেন শত্রুমুক্ত।

জগৎজ্যোতি দেশকে অমর জ্যোতি উপহার দিয়েছিলেন। নিজের জীবন দিয়ে শক্রুমুক্ত করেছিলেন প্রাণের চেয়ে প্রিয় স্বদেশভূমি।
মুক্তিযুদ্ধে অসীম অবদানের জন্য প্রবাসী সরকার প্রথম ব্যক্তি হিসেবে জগৎজ্যোতি দাসকে মরণোত্তর সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ প্রদানের ঘোষণা করে।
এদিকে এর প্রেক্ষিতে ‘স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র’, ‘আকাশবাণী’ তাকে ‘বীরশ্রেষ্ঠ জগৎজ্যোতি দাস’ নামে প্রচার করতে থাকে। পরবর্তীতে, যুদ্ধজয়ী বাংলাদেশে ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাব পরিবর্তন করে তাকে ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত করা হয়, সেটাও ২ দশক পর পান তিনি। শুধুমাত্র সিভিলিয়ান হবার অপরাধে কেড়ে নেয়া হয় তাঁর বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আজমিরীগঞ্জের নাম রাখা হয়েছিল ‘জগৎজ্যোতিগঞ্জ’। কিন্তু এটাও পরবর্তীতে অপরিবর্তিত অবস্থায় থাকতে পারেনি। বর্তমানে ওই অঞ্চলের নাম ‘আজমিরীগঞ্জ’ই।
অসীম সাহসী একজন মুক্তিযোদ্ধা দেশের জন্য জীবন বিলিয়ে দিলেন অথচ আমরা সামান্য একটা নামফলকে তার অসামান্য নামটি লিখে রাখতে পারলাম না..। দূর্ভাগ্য আমাদের এ জাতির।
জগৎজ্যোতি মানে পৃথিবীর আলো। আমাদের গর্ব, এ দেশে একজন ‘জগৎজ্যোতি’ ছিলো। যার বুকপকেটে এক পৃথিবীর সকল আলো ছিলো কিনা জানি না। তবে ছিল লক্ষ-কোটি মানুষের মুক্তির আভা।
বৃহত্তর সিলেট তথা ভাটি বাংলার এই বীর ও তার সঙ্গীরা নিজেদের জীবনের বিনিময়ে আমাদের জন্য আলো জ্বেলে গিয়েছিলো । সেই আলো কি এখন আমরা দেখতে পাই? সেই আলোতে কি আজকাল আমাদের দুচোখ ঝলমল করে ওঠে?
(লেখক : কবি ও সিনিয়র সাংবাদিক)